আমানতকারীরা কার কাছে যাবেন?
জাকির হোসেন: কয়েকদিন আগে একটি টিভি চ্যানেলে টকশোর বিরতিতে বেসরকারি একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বললেন, ‘সবাই আমাদের ব্যাংকের মালিক বলে। আসলে আমরা তো মালিক নই। ব্যাংকের মালিক তো আমানতকারীরা’। তার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে খুশি হয়ে প্রশ্ন করলাম. ‘ব্যাংকের উদ্যোক্তারা কি সবাই এমন ভাবেন? আপনাদের সংগঠন কি আমানতকারীদের স্বার্থ নিয়ে তৎপর? এর যথাযথ কোনো উত্তর তার কাছ থেকে পেলাম না।
ব্যাংকের উদ্যোক্তারা প্রায়ই সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দেখা করেন। অনেক সময় চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থে নানা সুবিধা আদায় করে নেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সুশাসনের পরিপন্থী মনে করলেও তারা ঠিকই এক পরিবার থেকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে চার জন থাকার দাবি আদায় করে নিয়েছেন। পরিচালক পদের মেয়াদ টানা ৬ বছরের জায়গায় ৯ বছর করতে পেরেছেন। সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। এবারের বাজেটে ব্যাংকের করপোরেট করও কমাতে সমর্থ হয়েছেন। অথচ ব্যাংকের তহবিলের ৯০ শতাংশের বেশি যাদের, সেই আমানতকারীদের পক্ষে জোরালো কোনো কন্ঠসর নেই। ব্যাংকের কর্মকর্তা ও উদ্যোক্তাদের অনিয়মের খেসারত প্রতিনিয়ত দিচ্ছেন আমানতকারীরা। ব্যাংক খাতে এই যে এত অনিয়ম, তা যদি না থাকতো তাহলে নিশ্চয় আমানতকারীরা একটু বেশি রিটার্ন পেতেন।
ব্যাংক খাতে সর্বশেষ আলোচিত বিষয় সুদের হার নিয়ে বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির সিদ্ধান্ত। গত ২০ জুন এক বৈঠক থেকে ঋণের সুদহার একঅংকে বা ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয় বিএবি। এ সিদ্ধান্তকে ব্যবসায়ীরা বাহবা দিচ্ছেন। কারণ তারা কম সুদে ঋণ পাবেন। তবে আমানতকারীরা খুশি হতে পারেননি। কারণ তারা সঞ্চয়ের বিপরীতে আগের চেয়ে কম সুদ পাবেন। কেননা ব্যাংকের উদ্যোক্তারা ঋণের সুদহার কমানোর জন্য আমানতের সুদহারও কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন। কয়েক মাস ধরে একটু বেড়ে মেয়াদি আমানতে সুদহার ১০ শতাংশ পর্যন্তও উঠেছে। সেই অবস্থায় এ সিদ্ধান্ত।
সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে আগামী ১ জুলাই থেকে। বিএবির ঘোষণা ছিল, ৩ মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। এখন শোনা যাচ্ছে, শুধু ৩ মাস নয়, যে কোনো মেয়াদের আমানতেই ৬ শতাংশের বেশি সুদ পাওয়া যাবে না। আবার বিএবি বলেছিল, সব ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ হবে। এখন ব্যাংকের এমডিরা সিদ্ধান্ত কার্যকরে প্রস্ততিমূলক বৈঠক করছেন। তাদের কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিল্পের মেয়াদি ঋণ, চলতি মূলধনসহ উৎপাদন খাতের ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামবে। ভোক্তা ঋণ, এসএমই কিংবা ক্রেডিট কার্ডে সুদহার কিছুটা কমলেও তা সিঙ্গেল ডিজিটে নামবে না। তাহলে কি হলো? আমানতের সুদহারের বেলায় সব ক্ষেত্রে কমবে অথচ ঋণের বেলায় নয়।
ব্যাংক যাদের টাকায় চলে সেই আমানতকারীরা আসলেই সব দিক থেকে বঞ্চিত। নানা পক্ষের অনিয়ম দুর্নীতিতে ব্যাংক লুট হয়ে যায়। অস্বাভাবিক পন্থায় মালিকানা বদল হয়। এতে শেষ পর্যন্ত কারও কিছু হয় না। শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যাংকে যারা টাকা রাখেন তারা। ওরিয়েন্টাল ব্যাংক বন্ধ হয়েছে ২০০৬ সালে। আসল টাকা তো দুরের কথা, যা ফেরত পাওয়ার কথা ছিল তাও পাননি অনেক সঞ্চয়কারী।
দেশে মোট ৫৭টি ব্যাংকে আমানত হিসাব রয়েছে প্রায় ১০ কোটি। আর ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা। একটি ব্যাংকে উদ্যোক্তাদের অর্থ থাকে ১০ ভাগের মতো। বাকি ৯০ ভাগ অর্থ আমানতকারীদের। ব্যাংকের প্রকৃত মালিক কিন্তু আমানতকারীরা। অথচ তারাই অভাগা। ব্যাংকের কাছে ঋণগ্রহীতাদের কদর বেশি। হোক না সে খেলাপি। ঋণ খেলাপিদের বিশেষ বিবেচনায় সুদ মওকুফ নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ঋণ খেলাপিরা নানান সুযোগ পান আর আমানতকারীরা নানা সার্ভিস চার্জ দিয়ে বছর শেষে আসল টাকাটাই আছে কিনা তার হিসাব কষতে বসেন।
লেখক: সাংবাদিক