ঢাকা: বাগেরহাটের শরণখোলার ধানসাগর ইউনিয়নের খেঁজুরবাড়িয়া, পশ্চিম রাজাপুর, দক্ষিণ রাজাপুর ও টগরাবাড়ি গ্রামগুলো একেবারেই সুন্দরবেনর গা ঘেঁষা। একমাস ধরে এসব গ্রামে বাঘের আনাগোনা টের পাচ্ছেন এলাকাবাসী। বাঘের গর্জনও শোনা যায় মাঝেমধ্যে। খালের চরে, ফসলি জমিতে বাঘের পায়ের অসংখ্য ছাপও দেখেছেন তারা।

এতে গ্রামবাসীর মধ্যে বিরাজ করছিল বাঘ আতঙ্ক। কিন্তু বাস্তবে কেউ এ পর্যন্ত বাঘের চেহারা দেখতে পাননি।

 

তবে বৃহস্পতিবার (৫ মে) রাতে ঠিকই সেই সুন্দরবনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখা মিলেছে খেঁজুরবাড়িয়া গ্রামে। এমনটাই দাবি করেন স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল হোসেন খান ও তার ছেলে শাহিন খান। তাদের মাছের ঘেরের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সেই শুকনো ঘেরেই রাজকীয় ভঙ্গিতে বসেছিল বাঘটি। পরে তাদের টর্চ লাইটের আলো দেখে বাঘটি পালিয়ে যায়।

এ ঘটনার পর পরই তারা স্থানীয় মসজিদের মাইক থেকে গ্রামে বাঘ আসার খরবটি প্রচার করে গ্রামবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। এতে গ্রামের মানুষের মধ্যে বাঘ আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে তোলে। নির্ঘুম রাত কেটেছে অনেকের।

বাঘ আসার ব্যাপারে বনবিভাগ জানায়, যে স্থানে বাঘ দেখার কথা বলা হচ্ছে, সেটি সুন্দরবন থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরত্বে। সেখানে সবই খোলা মাঠ। কোনো ঝোপ জঙ্গল নেই। বনের কাছাকাছি বহু মানুষের বসতি। অথচ, বাঘটি কারো সামনে পড়েনি। এটি বাঘ না অন্য কোনো প্রাণি তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে অনেকের মনে। তারপরও রাতে গ্রামের মানুষকে সতর্কতার সাথে চলাচল করতে বলা হয়েছে। এলাকায় বনরক্ষীসহ ভিটিআরটি, সিপিজি সদস্যদের পাহারা বসানো হয়েছে। বাঘ লুকিয়ে থাকতে পারে এমন ঝোপঝাড় ও গ্রামের বসতবাড়ির বাগান তল্লাশি করা হচ্ছে।

তবে, মাঝে মধ্যে বনলাগোয়া টগরাবাড়ি ও পশ্চিম রাজাপুর গ্রামের খালের চরে এবং ফসলের মাঠে বাঘের আনাগোনা টের পেয়েছে মানুষ। বাঘের পায়ের ছাপও দেখা গেছে এই এলাকার চরে ও ফসলের মাঠে। সুন্দরবনের ভোলা নদী ভরাট হওয়ার কারণে বন্যপ্রাণিরা অনায়াসে চলে আসতে পারে লোকালয়ে।

প্রত্যক্ষদর্শী ইউপি সদস্য মো. আবুল হোসেন খান বলেন, সেদিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে শাহিন খান টর্চ লাইট হাতে নিয়ে তাদের মাছের ঘেরের দিকে যায়। তার টর্চের আলো ঘেরের মধ্যে পড়তেই সামনে বাঘের মতো একটা কি যেন শুয়ে আছে দেখে চিৎকার দিয়ে বাড়ি দিকে ছুটে আসে। তার চিৎকার শুনে আমিও (বাবা) টর্চ লাইন নিয়ে বের হলে ছেলে জানায় ঘেরের মধ্যে বাঘ শুয়ে আছে। পরে আমি কাছে গিয়ে ঠিকই বাঘ দেখতে পাই। এসময় আমরা দুজনে টর্চ লাইট তার করলে বাঘটি লাফিয়ে ঘেরের বেড়ি লাফিয়ে বনের দিক লক্ষ্য করে ছুঁটতে থাকে। বাঘটি বনে চলে গেছে, না কোথাও লুকিয়ে আছে তা বলতে পারছি না। পরে বিষয়টি বনবিভাগকে জানানো হয়। এ ছাড়া মাইকিং করে গ্রামবাসীতে সতর্ক থাকতে বলি।

গ্রামের বাসিন্দা মো. হোসেন হাওলাদার (৬০), নাইম হাওলাদার (৩০), দুলিয়া বেগমসহ (৩৫) অনেকেই বলেন, বাঘর আসার খবর শোনার পর আমরা সারা রাইত ঘুমাইতে পারি নাই। এর আগেও টগরাবাড়ি গ্রামে বেশ কয়েকবার বাঘ আইছে। আমরা সবাই আতঙ্কে আছি।

ধানসাগর গ্রামের গ্রাম পুলিশ মো. তোফাজ্জেল হাওলাদার জানান, একমাস ধরে সুন্দরবনসংলগ্ন পশ্চিম রাজাপুর, দাসেরভারানি, খেঁজুরবাড়িয়া, টগড়াবাড়ি এলাকার লোকালয়ে বাঘ এসে প্রায়ই হানা হানা দিচ্ছে। এ ঘটনায় গ্রামবাসীর মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।

দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের সোবাহান হাওলাদার জানান, গত ২৪ এপ্রিল (রবিবার) দুপুরে টগরাবাড়ি খালের চলে আফজাল হোসেন নামে এক ব্যক্তির একটি গরুর ওপর আক্রমণ করেছিল বাঘ।

দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের সোবাহান হাওলাদার জানান, ৩১ মার্চ রাতে তার বাড়িতে এসে একটি মহিষের উপর আক্রমণ করে বাঘ।

বন বিভাগের ধানসাগর স্টেশন কর্মকর্তা (এসও) মো. আব্দুস সবুর বলেন, বাঘ আসার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে, এলাকাবাসী যেহেতু বাঘ দেখার কথা বলছেন, সেকারণে বনরক্ষীসহ কমিউনিটি প্যাট্রোলিং গ্রুপ (সিপিজি), ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের (ভিটিআরটি) সদস্যরা ওই গ্রামসহ আশপাশের এলাকায় পাহারা দিচ্ছেন। বাঘটি লোকালয়ে পাওয়া গেলে নিরাপদে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ভোলা নদী ভরাট হয়ে গ্রামের সাথে মিশে যাওয়ার কারণে প্রায়ই বন্যপ্রাণী লোকালয়ে ঢুকে পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে বণ্যপ্রাণী যাতে মারা না পড়ে সেব্যাপারে সব সময় সতর্ক রয়েছে বনবিভাগ।

সুন্দরবন খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দে বলেন, গত ২৮ মার্চ বন বনের কাছের ভোলা নদী ভরাট হওয়ায় বন্যপ্রাণীরা সহজেই গ্রামে ঢুকে পড়ছে। এ ব্যপারে বিভাগের উচ্চ পর্যায়ে নভা হয়েছে। লোকালয়ে যাতে বন্যপ্রাণী প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বনের ৬০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে নাইলনের দড়ি দিয়ে ঘেরা (বেড়া) দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন অর্থ ছাড় পাওয়া গেলে আগামী এক বছরের মধ্যে এ কাজ শুরু হবে। এছাড়া সুন্দরবন সুরক্ষ প্রকল্পের মাধ্যমে ভোলা নদী পুনঃখনন করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে।